চট্টলার কন্ঠস্বর মহিউদ্দিন চৌধুরীর বর্ণাঢ্য ৭৩ বছর

চট্টল কান্ডারী মহিউদ্দিন চৌধুরী। ফাইল ছবি

চট্টগ্রাম : ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর। বর্ণাঢ্য ৭৩ বছরের বিশাল ইতিহাস। রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে গ্রহণ করেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তাঁর পিতার নাম মরহুম হোসেন আহমদ চৌধুরি আর মাতা মরহুম বেদৌরা বেগম। আট ভাইবোনের মধ্যে মহিউদ্দিন মেঝ। পিতা চাকুরী করতেন আসাম বেংগল রেলওয়েতে। পিতার চাকরির সুবাদে মহিউদ্দিন পরাশুনা করেছেন মাইজদি জেলা স্কুল, কাজেম আলি ইংলিশ হাই, আর প্রবর্তক সংঘে। স্কুল জীবনেই জরিয়ে পরেন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে।

মাধ্যমিকের শেষে বাবার আদেশে ভর্তি হয়েছিলেন ডিপ্লোমা ইন্জিনিয়ারিং কোর্সে। সেখানের পাঠ না চুকিয়ে ভর্তি হন চট্টগ্রামের অন্যতম বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম কলেজে। বছর না ঘুরতেই কমার্স কলেজ, আর শেষমেষ সিটি কলেজ। সিটি কলেজেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন সদ্য প্রয়াত বর্ষীয়ান নেতা।

রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই সান্নিধ্য লাভ করেন জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিতে গিয়ে পাক বাহিনির কাছে গ্রেফতার হন অসংখ্যবার। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে আইএসআইয়ের চট্টগ্রাম নেভাল একাডেমী সদরদপ্তরের কাছে গ্রফতার হয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন দীর্ঘ চার মাস। পাক বাহিনির নির্যাতনের চিহ্ন মহিউদ্দীন মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর শরীরে বয়ে বেরিয়েছেন। তৎকালে তাঁর গ্রেফতারের খবরে ভারতের একটি মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে শহিদ মহিউদ্দীন ক্যাম্প খোলা হয়েছিলো। বেচে থাকার কথা ছিলোনা তাঁর। শহিদ ভেবে বাবা ছেলের নামে দিয়ে ছিলো ফাতেহা। এরি মাঝে একদিন মানসিক রোগীর নাটক করে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে পালিয়ে আসেন মহিউদ্দিন। পারি জমান ভারতে। সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে সক্রিয়ভাবে সম্মুখসমরে অংশ নেন। ছিলেন ভারত-বাংলা যৌথবাহিনীর মাউন্টেন ডিভিশনের অধিনে।

দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ঝাপিয়ে পরেন নতুন সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধুর খুবই কাছের আর আদরের ছাত্রনেতা ছিলেন মহিউদ্দীন। কিন্তু তৎকালীন সময়ে প্রবল ক্ষমতাশালি হয়েও ক্ষমতার মোহ একচুলও স্পর্শ করেনি তাঁকে।

চট্টল কান্ডারী মহিউদ্দিন চৌধুরী। ফাইল ছবি

কিছুদিন না যেতেই ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। অল্পের জন্য মহিউদ্দিন ধরা পরা থেকে বেচে যান, মৃত্যু বরন করেন সাথি মৌলভি সৈয়দ। পালিয়ে গিয়ে ভারতে প্রতিবিপ্লবীদের সাথে যোগ দেন। লক্ষ্য সামরিক জান্তা, খুনি মোশতাককে সামরিক ভাবেই পরাস্ত করা। কিছুদিন পরেই দলের নির্দেশে পন্থা পরিবর্তন করে আবার সক্রিয় হন প্রকাশ্য রাজনিতিতে।

দেশে এসে একের পর এক হুলিয়া। সামরিক বাহিনির হাতে নিপীড়ন, নির্যাতন, আর একের পর এক কারাভোগ। তখন মহামান্য স্বৈরাচার জিয়া ক্ষমতায়। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর জিয়ার দমন, বংঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে গোপন ষড়যন্ত্রের ভুমিকা, প্রতিবাদি করে তোলে মহিউদ্দিনকে। দলের নির্দেশে চলে বৈপ্লবিক প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ। তরণি ছাত্রনেতা মহিউদ্দিনের জুজুতে সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা তটস্থ। মাঝে আওয়ামী লীগের ভেতরেই ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর হয়ে উঠলো। বঙ্গবন্ধু কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভুমিকাকে নগণ্য করতে তাঁকে ঠেকাতে শত্রুরা উঠে-পরে বসলো। অদম্য সাহসী মহিউদ্দীন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় গিয়ে দলবল নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যার জন্য ঝাপিয়ে পরলেন। সব বাধা অতিক্রম করে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দলের কান্ডারীর দায়িত্ব নিতে সহয়তা করেন।

তারপর আসলো স্বৈরাচারি সামরিক জান্তা এরশাদ। তারই শাসনামলে চট্টগ্রামে স্বয়ং জান্তা প্রধানকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে চক্ষুসুল হন সরকারের। ফলে আবারও রাজনৈতিক বন্দি। ততদিনে চট্টগ্রামের আপামর জনতার নয়নমনি হয়ে উঠেন মহিউদ্দীন চৌধুরী।

পরবর্তীতে নব্বইয়ের গণআন্দোলনে অগ্রণী ভুমিকা রেখে গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তির অন্যতম সুপুরুষ বলে বিবাচিত হন সর্ব মহলে। রাজাকার আর সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ক্রমাগত পরাস্থ করে, একানব্বইয়ের ঘুর্নিঝড়ে সহায়-সম্বলহীন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে, অসহযোগ আন্দোলনে খালেদার সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, গরিব-দুঃখি-শ্রমিকের অধিকারের কথা বলে মহিরুহে পরিণত হন মহিউদ্দীন চৌধুরী।

চট্টল কান্ডারী মহিউদ্দিন চৌধুরী। ফাইল ছবি

এতকিছুর পরও থেমে থাকেননি এই উদ্যমী জননেতা। গনমানুষের তথা চট্টগ্রামের উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্রমাগত ছুটে চলেছেন। উপেক্ষা করেছেন রক্তচক্ষু। চালিয়ে গেছেন উন্নয়নের চাকা। উড়িয়ে চলেছেন অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনীতি আর মুল্যবোধের পতাকা।

সর্বশেষ নির্যাতিত হন রাজনীতি পরিশোধনের নামে নেমে আশা সামরিক শকুনের ওয়ান ইলেভেনের শাসনামলে। ষাটোর্ধ বয়সে কারান্তরিন ছিলেন দীর্ঘ দুই বছর। এরমধ্যেই নির্মম ভাবে ইন্তেকাল করেন আদরের মেয়ে ফওজিয়া সুলতানা টুম্পা। নানান টালবাহানা করে টুম্পাকে মৃত্যু অবধারিত জেনেও দেখতে দেয়নি। এই বেদনা মহিউদ্দীনকে আমৃ্ত্যু কাঁদিয়েছে।

জনগণের ভোটে তিন তিন বার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন মহিউদ্দীন। জনতার রায়ে, তাদের ভালবাসায় সিক্ত হয়েছেন। গণমানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে, শত কষ্ট, বেদনা, অসুস্থতায় ভুগে, নির্যাতন সহ্য করে, পরিবার পরিজনকে সময়-অসময়ে, ঘটনা-দুর্ঘটনায় হারানো চট্টল কান্ডারী আজ সবাইকে ছেড়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। আল্লাহ তাঁকে জান্নানতবাসী করুন।

শেয়ার করুন