নারীদের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করছে ফাতেমা পারুল

জয়িতা নারী নেত্রী ফাতেমা পারুল

লামা প্রতিনিধি : নারী মানে কেনা গোলাম। নারী যেন অন্যের করুনার পাত্র। নারীর প্রতি সমাজের এমন দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর প্রত্যয় নিয়ে কাজ করছে ‘নব জাগরণ মহিলা উন্নয়ন সমিতি’। শুধু তাই নয়, এ সমিতির মাধ্যমে নারীদের ভাগ্যোন্নয়নেও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বান্দরবানের লামা উপজেলার নারী উদ্যোক্তা ফাতেমা পারুল। অসহায়, দরিদ্র, স্বামী পরিত্যক্ত, বিধবা, অস্বচ্ছল পরিবারের নারীদের নিয়ে কাজ করছেন তিনি। ফাতেমা পারুলের এ মহতি উদ্যোগের কারণে এখন দু’শতাধিক নারী আত্ম-কর্মসংস্থানের পথ খুঁজে পেয়েছেন। অনেকে এখানের আয় দিয়ে এখন সংসার চালাচ্ছেন।

ফাতেমা পারুল ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারী বান্দরবানের লামা পৌরসভার চাম্পাতলী গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। বাবা মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক ও মা আনোয়ারা বেগম। এক ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ১৯৯০ সালে লামা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশের পর আর পড়ালেখা করার সৌভাগ্য হয়নি ফাতেমা পারুলের। ২০ বছর বয়সে পশ্চিম রাজবাড়ী আবদুল আজিজের সঙ্গে তাকে বিয়ে দেন মা-বাবা। স্বামী আবদুল আজিজ বাংলাদেশ আনসার ব্যাটালিয়নের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। বর্তমানে স্বামী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। বর্তমানে তিনি বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের একজন সদস্য। রাজনৈতিক জীবনে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের উপজেলা সভানেত্রী। অর্থনৈতিকভাবে সফল নারী হওয়ায় ২০১৭ সালে উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর তাকে অনুুষ্ঠানিকভাবে জয়িতা সম্মাননা প্রদান করে। সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে আশপাশের অবহেলিত পিছিয়ে পড়া দরিদ্র নারীদের নিয়ে কিছু একটা করার কথা ভাবতেন ফাতেমা পারুল। তখন থেকে বিভিন্নভাবে অসহায় নারীদের সহায়তাও করতেন তিনি।

এক পর্যায়ে ২০০১ সালে লামা পৌরসভার প্রথম নির্বাচনে অংশগ্রহন করে ৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হন ফাতেমা পারুল। কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর অবহেলিত নারীদের উন্নয়নে কাজ করার সুযোগ আরো প্রসারিত হয়। তিনি অবহেলিত দরিদ্র নারীদের আত্ম-কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারী নিজের বাড়ীর উঠানে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নব জাগরণ মহিলা উন্নয়ন সমিতি’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। মাত্র ১৫ জন নারী নিয়ে শুরু করেন সংগঠনের কার্যক্রম। বর্তমানে দেড় শতাধিক অবহেলিত নারী এ সংগঠনের সদস্য রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই সমিতির উদ্যোগে শুরু থেকে বাল্য বিবাহ রোধ, নারী নির্যাতন, যৌতুক প্রথা, শিশু পাচার রোধে সচেতনতা মূলক সভা সেমিনারসহ জাতীয় দিবসের মধ্যে নারী দিবসসহ বিভিন্ন দিবস পালন করা হয়। এছাড়া এলাকার অবহেলিত দরিদ্র নারীদের আত্ম-কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ইতিমধ্যে এই সমিতির মাধ্যমে বেশ কয়েক ধাপে প্রায় দু শতাধিক বেকার নারীকে সেলাইসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষন দেয়া হয়। তাদের মধ্যে কিছু নারী সেলাই, আর কিছু পুতির তৈরি টিস্যু বক্স, নকশি কাঁথা, বল্ক-বাটিক, বাঁশ-বেত ও বিভিন্ন ফুলের টপ তৈরীকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে এ কাজ করে এখন সংসার চালায়। স্বামীর পাশাপাশি ছেলে মেয়েদের পড়া লেখার খরচও যোগান দেন প্রশিক্ষিত এ নারীরা। লামা পৌর এলাকার কলিঙ্গাবিলের কামাল উদ্দিনের স্ত্রী মুক্তা বেগম, কাটা পাহাড়ের মোশারফের স্ত্রী রোকসানা বেগম, চরোয়া বিলের রাশেদা বেগম, পশ্চিম রাজবাড়ীর শাহেনা বেগম, নুরজাহান বেগম, আনোয়ারা বেগম ও মধুঝিরি গ্রামের লায়লা বেগম উল্লেখযোগ্য। বর্তমানেও নারীদের কারিগরিভাবে দক্ষ করে তুলতে পাপস বুনন, অ্যামব্রয়ডারী, বাটিক, বুটিকসহ মোট ৯টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে এ সমিতিতে। আবার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা নিজেদের দক্ষ করে এসব কাজের মাধ্যমে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন। প্রতিভাবান এ ফাতেমা পারুলের অক্লান্ত পরিশ্রম আর মেধার সমন্বয়ে ২০০০ সালে সমিতিটি মহিলা বিষয়ক ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর কর্তৃক রেজিষ্ট্রেশন লাভ করে আরো একধাপ এগিয়ে যায়। শুরুতে বাঁশের বেড়া ও ছনের ছাউনির ঘর দিয়ে সমিতির কার্যক্রম শুরু করা হয়।

প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর ঊশৈসিং এমপির প্রচেষ্টায় ২০১২-১৩ অর্থ বছরে সরকারী ভাবে এডিবি’র অর্থায়নে একটি টিনের ছাউনি ও টিনের বেড়া ঘর নির্মান করে দেয়া হয়। সমিতির প্রশিক্ষণার্থী নুরজাহান বেগম, আনোয়ারা বেগম ও লায়লা বেগম জানায়, স্বামী মানুষের জমিতে শ্রমিকের কাজ করেন। তার আয় দিয়ে সন্তানের লেখাপড়া ও সংসার চলেনা। নারীনেত্রী ফাতেমা পারুলের সহযোগিতায় আমরা নকশিকাঁথা, বল্কবাটিক, সেলাই কাজ করছি। এখান থেকে আমরা প্রতিমাসে তিন থেকে চার হাজার টাকা করে আয় করি।

এ বিষয়ে বেগম ফাতেমা পারুল বলেন, অবহেলিত নারীদের প্রশিক্ষনের মাধ্যমে আত্ম-কর্মসংস্থানসহ ভাগ্য বদলানোর চেষ্টা করছি মাত্র। আবার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের উৎপাদিত পণ্যসমূহ যেন সঠিক দামে ও ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারে সেজন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের সাথে সমন্বয় করছি। পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুরের আন্তরিকতায় এসব সম্ভব হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়ের মধ্যে একটি হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। ডিজিটাল বাংলাদেশ বির্নিবান, ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে এসকল অসহায় নারীদের এগিয়ে নিতে হবে।

লামা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সুষ্মিতা খীসা বলেন, দেশকে উন্নতশীল করতে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও আয় বৃদ্ধিমূলক কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। এতে প্রতিটি পরিবারে অর্থের সংকট দূর হওয়ার পাশাপাশি পরিবার তথা সমাজে অর্থনৈতিক বিল্পব ঘটবে। তিনি আরও বলেন, নব জাগরণ মহিলা উন্নয়ন সমিতির মাধ্যমে নারীদের আয় বৃদ্ধিমূলক কাজে সম্পৃক্ত করে ফাতেমা পারুল অনেক বড় কাজ করছেন। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে ২০১৭ সালে এ নারী নেত্রীকে জয়িতা সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

শেয়ার করুন