পতাকায় প্রাণ ভরে, পেটও ভরে

বিজয়ের মাসে নগরজুড়ে মৌসুমি পতাকা ফেরিওয়ালা সেন্টু শেখ। ছবি: এমএ হান্নান কাজল

চট্টগ্রাম : বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। মাসজুড়েই বিজয়ের উল্লাস। আসছে ১৬ ডিসেম্বর দেশ জয়ের ৪৭ বছরপূর্তি। এবছর বিজয়োল্লাসে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। স্বভাবতই বাড়ছে জাতীয় পতাকার কদর, বাড়ছে চাহিদাও। চাহিদা পুরণে থেমে নেই পতাকা তৈরির কারিগর-বিক্রেতাও। বহু মৌসুমি ফেরিওয়ালা কাধে তুলে নিয়েছেন জাতীয় পতাকা। নগরজুড়েই তাদের কাধের দন্ডে পত্পত্ উড়ছে বিজয় নিশান। বিজয় বিদস পর্যন্ত ভালো বেচা-বিক্রি চলবে_জানালেন পতাকা ফেরিওয়ালা।

আরো পড়ুন : চট্টগ্রামে ১৬ আসনে জোট মহাজোটের প্রার্থী চূড়ান্ত

নগরীর নাসিরাবাদ এলাকায় পতাকা বিক্রয় করছিলেন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই ফেরিওয়ালা। আলাপকালে তিনি বলেন, সারা বছরই মজুরি খাটি। ফাঁকে খেলনা, বই ফেরি করি। ডিসেম্বরের শুরুতেই আসি এখানে, তয় এইবার একটু দেরি হইছে। ঘুইরে ঘুইরে পতাকা বেচি। আছে নানান ধরনের বেচলেট, মাতলা। তাতেও লেখা ‘মহান বিজয় দিবস’। ছোট আকারের পতাকাও হাতভর্তি। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগে শুধুই পতাকা। কাধের দন্ডে পত্পত্ করে উড়ছে লাল সবুজের বিজয় নিশান। দাম কত জানতে চাইলে হাসিমাখা মুখে চটপট উত্তর, পতাকার দাম(?) কত আর দিবেন। পতাকা বেইচা তো আর পেট ভরে না, তয় প্রাণ ভরে। নিমিষেই থমকে গেলেন এই প্রতিবেদক। ফেরিওয়ালার স্বভাবসুলভ চোখের নাচন, ঠোঁটের ভাষা তেজষীয় প্রাণময়। দাম-তর্ক না বাড়িয়ে মাঝারি সাইজের একখানা পতাকা পেকেট করে পকেটে পুড়তে-পুড়তে নাম জানতে চাইলেই বললেন, সেন্টু শেখ।

বিজয়ের মাসে নগরজুড়ে মৌসুমি পতাকা ফেরিওয়ালা। ছবি: এমএ হান্নান কাজল

এরপর সেন্টু শেখ বললেন বহু কথা। জানালেন, দীর্ঘ দেড়যুগ ধরে প্রাণের উচ্ছ্বাসেই সুদূর গোপালগঞ্জ থেকে বন্দর নগরীতে আসেন ঊনপঞ্চাশ বছরের সেন্টু শেখ। সপ্তাহ দুয়েক পতাকা বেচা-বিক্রিশেষে আবার আপন ঘরে ফিরবেন তিনি। শুধু সেন্টু শেখই নন। তার সাথে প্রতি বছরই আসেন আরো অন্তত জনা বিশ-বাইশ পতাকা বিক্রেতা। তাদের সকলের বাড়ি গোপালগঞ্জে। তারা আবাস গেঁড়েছেন বাকলিয়ায়। একসাথেই থাকেন, নগরজুড়ে ফেরি করেন জাতির নিশান, জাতীয় পতাকা।

কথা প্রসঙ্গে কিঞ্চিৎ ক্ষোভও ঝারলেন সেন্টু শেখ। বললেন, দেশের বহু সমাজ সচেতন মানুষও জাতীয় পতাকার মর্যাদা সম্পর্কে জানেন না। কোথায় কখন জাতীয় পতাকা কিভাবে উত্তোলিত হবে তাও জানেন না। বহু তরুন জানেন না জাতীয় পতাকার মাপ, জাতীয় পতাকা কে কখন কোথায় প্রথম উত্তোলন করেছিলেন। জাতীয় নিশান তৈরি করেন কে তাও জানেন না বহু শিক্ষিত যুবক। কিন্তু সেন্টু শেখ সে তুলনায় বহু এগিয়ে। লাল সবুজ পাতাকার প্রতি রয়েছে তার অসামান্য সম্মান, অফুরান শ্রদ্ধা। অল্পে তুষ্ট সেন্টু শেখ এবার তৃপ্তির ঢেকুর তুলেই বললেন, পতাকায় এখন পেটও ভরে, প্রাণও ভরে।

যেভাবে শুরু পতাকা
স্বাধীন দেশে প্রথম যে পতাকাটি উড়েছিল ওই পতাকাটি আজকের পতাকার মতো ছিল না। ওই পতাকাটি এঁকেছিলেন স্বভাবশিল্পী ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশ। ওই পতাকা তৈরির জন্য কাপড় দিয়েছিলেন ঢাকা নিউমার্কেটের অ্যাপোলো টেইলার্সের মালিক বজলুর রহমান লস্কর। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান কলাভবনের সামনের পশ্চিম গেটেই বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলিত হয়। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব। আমাদের সেই আদি পতাকার মাঝখানে হলুদ বৃত্তের মধ্যে ছিল বাংলাদেশের মানচিত্র।

বিজয়ের পর ১৯৭২ সালে শিবনারায়ণ দাশের ডিজাইন করা পতাকার মাঝে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রং ও তার ব্যাখ্যা-সংবলিত একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয় পটুয়া কামরুল হাসানকে। কামরুল হাসান আমাদের জাতীয় পতাকার যে রূপ দিয়েছিলেন, সেটিই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চে তাঁর বাসভবনে, স্বাধীনতা ঘোষণার প্রাক্কালে পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।

সরকারি স্বীকৃতি
আমাদের জাতীয় পতাকা সবুজ আয়তক্ষেত্রের মধ্যে লাল বৃত্ত। সবুজ রং বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি ও তারুণ্যের প্রতীক, বৃত্তের লাল রং উদীয়মান সূর্য, স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারীদের রক্তের প্রতীক। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার এই রূপটি ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি সরকারিভাবে গৃহীত হয়।

আকার
বাংলাদেশের পতাকা আয়তাকার। এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত ১০:৬ এবং মাঝের লাল বর্ণের বৃত্তটির ব্যাসার্ধ দৈর্ঘ্যের পাঁচ ভাগের এক ভাগ, পতাকার দৈর্ঘ্যের ২০ ভাগের বাঁ দিকের নয় ভাগের শেষ বিন্দুর ওপর অঙ্কিত লম্ব এবং প্রস্থের দিকে মাঝখান বরাবর অঙ্কিত সরল রেখার ছেদ বিন্দু হলো বৃত্তের কেন্দ্র।

পতাকার দৈর্ঘ্য ১০ ফুট হলে প্রস্থ হবে ৬ ফুট, লাল বৃত্তের ব্যাসার্ধ হবে ২ ফুট, পতাকার দৈর্ঘ্যের সাড়ে ৪ ফুট ওপরে প্রস্থের মাঝ বরাবর অঙ্কিত আনুপাতিক রেখার ছেদ বিন্দু হবে লাল বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু।

ব্যবহারভেদে পতাকার মাপ
ভবনে ব্যবহারের জন্য পতাকার বিভিন্ন মাপ হলো ১০ ফুট বাই ৬ ফুট, ৫ ফুট বাই ৩ ফুট এবং ২৫ ফুট বাই ১৫ ফুট। মোটরগাড়িতে ব্যবহারের জন্য পতাকার বিভিন্ন মাপ হলো ১৫ ইঞ্চি বাই ৯ ইঞ্চি এবং ১০ ইঞ্চি বাই ৬ ইঞ্চি। আন্তর্জাতিক ও দ্বিপক্ষীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য টেবিল পতাকার মাপ হলো ১০ ইঞ্চি বাই ৬ ইঞ্চি।

ব্যবহারবিধি
বিভিন্ন জাতীয় দিবসে সরকারি ও বেসরকারি ভবন, বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশন ও কনস্যুলেটে পতাকা উত্তোলন করতে হবে। শোক দিবসে পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। পতাকা অর্ধনমিত রাখার ক্ষেত্রে প্রথমে পতাকা শীর্ষস্থান পর্যন্ত ওঠাতে হবে। তারপর অর্ধনমিত অবস্থানে রাখতে হবে। দিনের শেষে পতাকা নামানোর সময পুনরায় শীর্ষস্থান পর্যন্ত উঠিয়ে তারপর নামাতে হবে।

অপরাধ
সরকারের অনুমতি ছাড়া জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা যাবে না। জাতীয় পতাকার ওপর কিছু লেখা অথবা মুদ্রণ করা যাবে না। এমনকি কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে কিছু আঁকা যাবে না।

পতাকা আমার প্রাণ
আমরা এখন পোশাকেও পতাকার আলো দেখি। অর্থাৎ আমাদের জাতীয় পতাকার রঙের ব্যবহার লক্ষ করি শাড়িতে পাঞ্জাবি আর কামিজেও। পতাকার চেতনা যে আমাদের মননে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে সে কথা আলাদা করে আর বলবার দরকার নেই। আমাদের জাতীয় পতাকার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা মানে মহান মুক্তিযোদ্ধাদেরই সম্মান করা।

শেয়ার করুন