খাগড়াছড়িতে সুপেয় পানির হাহাকারে ৭শ’ পরিবার

শংকর চৌধুরী: খাগড়াছড়িতে সুপেয় পানির জন্যেই বছরের পর বছর ধরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষের নিরন্তর সংগ্রাম চলছে। পাহাড়, ঝিরি, ঝর্ণা, ছড়া ও বিস্তৃত অরণ্যের জেলা খাগড়াছড়ি। এ জেলায় বসবাসরত দুর্গম এলাকার বাসিন্দাদের পানির সংকট চিরস্থায়ী।

সারাবছরই লেগে থাকে এই সংকট। বর্ষা মৌসুমে খোলা উৎস অর্থৎ ছড়া, ঝিরি কিংবা কূয়াতে পানি থাকলেও অধিকাংশ সময় তা দূষিত থাকে। আর শুষ্ক মৌসুমে তো হাড়ভাটা, পানির জন্য তীব্র হাহাকার থাকে পাহাড়ি এলাকা জুড়ে।

দুর্গম পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট একটি কূয়া। সেই কূয়া থেকে পানি সংগ্রহ করছেন, হর্ণ দেবী ত্রিপুরা ও রবিতা ত্রিপুরাসহ বেশ কজন নারী এবং কিশোরী। প্রাত্যহিক ভোরে সংসারের গৃহিনী ও কন্যা শিশুদের প্রথম কাজ হলো বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের ছড়া, ঝিরি কিংবা কূয়া থেকে খাওয়া এবং রান্না-বান্নার জন্য পানি সংগ্রহ করতে যাওয়া।

রোজ প্রভাতে তাদের উঁচুনিচু পাহাড় বেয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়। পানির জন্য ওঠানামা করতে হয় অন্তত দেড় হাজার ফুট উচ্চতার আঁকাবাঁকা পাহাড়। চিত্রটি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের তপন কুমার কার্বারী পাড়া এলাকার। এমন দূর্দশা কেবল তপন কুমার কার্বারী পাড়ার বাসিন্দাদেরই নয়। মেরুং ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের ১২ গ্রামের সাত শতাধিক পরিবারের এই দুর্ভোগ জন্মান্তরের।

সম্প্রতি দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের ১২টি গ্রাম ঘুরে দেখা যায় দুর্ভোগের বাস্তব চিত্র। রথীচন্দ্র কার্বারী পাড়া, তপন কুমার কার্বারী পাড়া, মিলন কুমার কার্বারী পাড়া, চন্দ্রকীরণ কার্বারী পাড়া, সীমানা পাড়া, কালীদাস কার্বারী পাড়া, তৈদু পাড়া, মায়াফা পাড়া, ভৈরফা পাড়া, সাধন মনি পাড়া, গন্ডা পাড়া ও ফরেস্ট বাগান টিলা এলাকায় সুপেয় পানির কোনো বন্দোবস্তই নেই। এসব এলাকায় মাটির নিচে পাথরের শক্ত বেষ্টনী থাকায় নলকূপ স্থাপনও সম্ভব হয় না। ফলে খোলা উৎসের পানিই একমাত্র ভরসা এসব এলাকার বাসিন্দাদের।

সীমানা পাড়া এলাকার বাসিন্দা মদ্দকিনি ত্রিপুরা বলেন, ‘প্রায়শই বানরের দল কূয়ার পানি নোংরা করে রাখে। তখন কূয়ার পানি পরিষ্কার হতে
ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। আর সে কারণেই ভোরের আলো ফুটলেই বেরিয়ে পড়তে হয় পানির জন্য।’

মিলন কার্বারী পাড়ার অনতি ত্রিপুরা বলেন, ‘প্রতিদিন অন্তত দু’বেলা করে পানি সংগ্রহ করি আমরা। আর এসব পানি খাওয়া এবং রান্না-বান্নার কাজে ব্যবহার করি।’

রথীচন্দ্র কার্বারী পাড়ার বাসিন্দা হৈমন্তী ত্রিপুরা বলেন, ‘বর্ষায় পানি থাকে দূষিত আর শুষ্ক মৌসুমে তীব্র খরা। কিন্তু বিকল্প কোন উপায় নেই। ঘরে
ঘরে সর্দি, কাশি ও জ¦র লেগেই থাকে আমাদের।’

খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন নূপুর কান্তি দাস বলেন, ‘খোলা উৎসের পানি ফুটিয়ে পান করেন না প্রত্যন্ত এলাকার মানুষগুলো। দূষিত পানি
পান করার ফলে বর্ষা মৌসুমে হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়া, আমাশয় ও পেটব্যথাসহ পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা বাড়ে।’

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য গণেশ চন্দ্র ত্রিপুরা জানান, ‘১নং ওয়ার্ডের ১২টি গ্রামে প্রায় সাত শতাধিক পরিবার রয়েছে। অথচ একটি গ্রামেও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই। ঝিরি ও ঝর্ণা থেকেই পানি সংগ্রহ করতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের।’

তিনি আরও জানান, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কয়েকবার গভীর নলকপ স্থাপনের উদ্যোগ নিলেও মাটির নিচে পাথরের বেষ্টনীর কারণে তা কোনো কাজে আসেনি। এসব এলাকায় ঝিরিতে বাঁধ দিয়ে এবং কুয়া থেকে পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে হবে। পাড়া সংলগ্ন এলাকায় পানির ট্যাংক বসিয়ে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে তবেই এই দুর্ভোগ দূর হবে।

খাগড়াছড়ি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রেবেকা আহসান বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে সমগ্র দেশ পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় ওই গ্রামগুলোতে ‘ওয়াটার সাপ্লাই স্কিম’ স্থাপন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এসব এলাকার সুপেয়
পানির সংকট দূর হবে।’

তিনি বলেন, একসময় এ জেলায় বিশুদ্ধ পানির সংকট ছিলো প্রকট। তবে গেল এক যুগে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে দারুণ অগ্রগতি হয়েছে। যেখানে ২০০৯ সালে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মোট জনসংখ্যার ২৮.৫৭ শতাংশ বিশুদ্ধ পানির আওতায় ছিলো সেখানে ২০২১ সালে কাভারেজের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮.৪০ শতাংশে।

শেয়ার করুন