সরকারি কাজ, তাই পরিবহণ আইন মানছে না আর এম মোটরস

অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই আর এম মোটরস এর লরি দাবিয়ে বেড়াচ্ছে চট্টগ্রাম-নারায়নগঞ্জ সড়ক

চট্টগ্রাম : কথা ছিল একটি লরিতে একটি ডাকটাইল পাইপ পরিবহণ করার। কিন্তু সে নিয়ম ভেঙ্গে তিনটি পাইপ নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ছুটে যাচ্ছে নারায়নগঞ্জ। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কাই করছে না আর এম মোটরস নামের প্রতিষ্ঠানটি। সরকারি কাজের দোহাই দিয়ে সড়ক পরিবহন আইনও মানছে না প্রতিষ্ঠানটি। গণমাধ্যমে ব্যাপক সংবাদ প্রকাশের পরও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই করে দাপিযে বেড়াচ্ছে চট্টগ্রাম-নারায়নগঞ্জ সড়ক। তাদের কৌশলের কাছে হার মানছে প্রশাসন? এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে সড়কজুড়ে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, লরির মূল বডির সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে ক্লাম, তাই দিয়ে বডি কিছুটা বাড়ালেই রাখা যায় তিনটি ডাকটাইল পাইপ। ঝুঁকিপূর্ণ এবং আইনসম্মত নয়, তবে রাখা যায় এবং পরিবহন করাও হচ্ছে রীতিমতো। সারা পথে আইন মানানোর জন্য সরকারের ট্রাফিক পুলিশসহ আরও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরদারি আছে, তবে এমন লরির স্ফীত বডি দেখে তাদের কেউ আর এগিয়ে আসছেন না।

অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই আর এম মোটরস এর লরি দাবিয়ে বেড়াচ্ছে চট্টগ্রাম-নারায়নগঞ্জ সড়ক

ডাকটাইল পাইপ পরিবহন করা লরির বডি দুই পাশে বাড়ানো হয়েছে দুই ফুট করে চার ফুট। বিপরীত দিক থেকে যে গাড়িগুলো আসবে এমন বিসদৃশ মাপের কারণে সেগুলোর দুর্ঘটনায় পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

মোটরযান আইন:
আইন বলা হয়, যানবাহনের মোট দৈর্ঘ্য (বডি) চাকার মাপের খুব বাইরে যেতে পারবে না। আর চালকের কেবিন ও মালামাল বহনের অংশের মাপ সমান হবে। কিন্তু এই নিয়মের তোয়াক্কা না করেই ঢাকা ওয়াসার একটি প্রকল্পের জন্য আনা ডাকটাইল পাইপগুলো পরিবহনের জন্য লরির বডি দুই পাশে দুই ফুট করে বাড়িয়ে দিব্বি চালাচ্ছে ‘আর এম মোটরস’। একটি লরিতে যেখানে একটি ডাকটাইল পাইপ পরিবহনের কথা, সেখানে এমন ক্লাম লাগানো শেপে (আকার), দিব্বি মেপে তুলে দিচ্ছে তারা ৮ টন ওজনের একের বদলে তিনটি ডাকটাইল।

অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই আর এম মোটরস এর লরি দাবিয়ে বেড়াচ্ছে চট্টগ্রাম-নারায়নগঞ্জ সড়ক

বিষয়টি জানতে চাইলে আর এম মোটরস এর চট্টগ্রামস্থ গ্যারেজের ম্যানেজার মোরশেদ বলেন, ‘সরকারের মাল আমাদেরকে যেভাবে পরিবহন করতে বলেছেন আমরা সেইভাবে পরিবহন করছি। আমাদেরকে এক সাথে তিনটা ডাকটাইল পাইপ পরিবহন করতে বলেছেন, আমরা তাই করছি।’ তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ‘এর আগে আলী এন্টারপ্রাইজ এভাবে দেড় হাজার পাইপ পরিবহন করেছে। আমরাও সেইভাবে পরিবহন করছি।’

আরো পড়ুন : ২৫ এপ্রিল থেকে খুলবে দোকান-শপিংমল
আরো পড়ুন : চলে গেলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাহাবউদ্দিন

এদিকে ‘সরকারের মাল’ বলে আর এম মোটরস নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করলেও পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বডি বাড়িয়ে এভাবে ডাকটাইল পাইপগুলো পরিবহন করার কারণে যে কোনও সময় ঘটতে পারে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। কারণ একটি গাড়ি যখন মূল বডির বাইরে মালামাল পরিবহন করে তখন ওই গাড়ি খুব সর্তকর্তার সঙ্গে চালাতে হয়। না হয়, সড়কে অন্য গাড়ির সঙ্গে লেগে যেকোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আবার ওই গাড়ি সতর্কতার সঙ্গে চালালেও সড়কে থাকা অন্য পরিবহনগুলোও যেহেতু দ্রুতগতিতে চলাচল করে থাকে তাই স্বাভাবিক মাপের চেয়ে বড় লরিতে অনিচ্ছায় তারা আটকে গিয়ে বা ধাক্কা লেগে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’

অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই আর এম মোটরস এর লরি দাবিয়ে বেড়াচ্ছে চট্টগ্রাম-নারায়নগঞ্জ সড়ক

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রেইল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর ছিদ্দিক বলেন, বডি বাড়িয়ে মালামাল পরিবহন করলে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটবেই। ডাকটাইল পাইপ পরিবহনের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটা দুর্ঘটনা ঘটেছেও। নিয়ম মেনে পাইপগুলো পরিবহন করার জন্য আমরা প্রতিষ্ঠানটিকে একাধিকবার বলেছি। কিন্তু তারা সেটি না করে পুলিশ এবং সড়ক ও জনপদের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে একটি লরিতে একটির জায়গায় তিনটি পাইপ পরিবহন করছে।’

লম্বায় ২৮ ফুট, ৭২ ইঞ্চি গোলাকৃতির প্রতিটি ডাকটাইল পাইপের ওজন ৮ টন। নিয়ম অনুযায়ী একটি ট্রেইলরে করে একটি পাইপ পরিবহনের কথা। এই নিয়ম মেনেই তারা পাইপগুলো বন্দর থেকে বের করে টোল রোডের পাশে একটি লোকাল শেডে রাখে। সেখান থেকে তারা এক লরিতে তিনটি করে পাইপ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছে। লুকিং গ্লাসে গাড়ির পেছনের অংশ দেখতে না পাওয়া অবস্থায় নির্ধারিত ওজনের তিনগুণ বেশি ওজন নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ আসছে এসব লরি!

নগরীর টোল রোড এলাকায় গিয়ে এ ধরনের বেশ কয়েকটি লরি দেখা যায়। প্রত্যেকটি লরিতে তিনটি করে পাইপ পরিবহন করা হচ্ছে। ভালো করে তাকালে বোঝা যায়, তিনটি পাইপ পরিবহন করার জন্য লরির দুই পাশে অ্যাঙ্গেল লাগিয়ে লরির বডি দুই ফুট করে চার ফুট করে বাড়ানো হয়েছে। এভাবে বাড়ানো বডিতে দুইটি এবং তার ওপর আরও একটি পাইপ রেখে বেল্ট দিয়ে বেঁধে পাইপগুলো পরিবহন করা হচ্ছে। যে কোনোভাবে যদি বেল্ট ছিঁড়ে যায় তাহলে এই লরির পক্ষে ৮ টন ওজনের পাইপগুলো আর আটকে রাখা সম্ভব হবে না। আর এগুলো রাস্তার ওপরে পড়ে যে কোনও মুহুর্তে দুর্ঘটনার সৃষ্টি হতে পারে। জানা গেছে, এভাবে পরিবহন করায় গত ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাট এলাকায় একটি দুর্ঘটনাও ঘটেছে।

এ প্রসঙ্গে হক্কানী মোটরসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সুজা উদ্দিন বলেন, ‘একটি লরিতে তিনটি ডাকটাইল পাইপ পরিবহন করা অনেক ঝুঁকির কাজ। তাই আমাদেরকে পাইপগুলো পরিবহন করতে বলার পরও আমরা কাজটি নেইনি।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই ডাকটাইল পাইপগুলো নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ঢাকা ওয়াসার ‘গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার’ প্রকল্পের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চীনে তৈরি এসব ডাকটাইল পাইপ নিয়ে আসে ঢাকা ওয়াসার ওই প্রকল্পের কাজ পাওয়া ফ্রান্সভিত্তিক কোম্পানি ‘সুয়েজ’। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নিয়ে আসা এই পাইপগুলো ‘এডিটর’ নামে ঢাকার একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানি বন্দর থেকে খালাস করে। এরপর প্রতিষ্ঠানটি পাইপগুলো পরিবহনের জন্য ‘আর এম মোটরস’কে দায়িত্ব দেয়। আর এম মোটরস পাইপগুলো চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ঢাকা ওয়াসার গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার প্রকল্প এলাকায় নিয়ে যাচ্ছে। ওই প্রকল্পের জন্য মোট ২ হাজার ৯০০টি পাইপ নিয়ে আসা হয়েছে। নভেম্বর মাসে কিছু পাইপ পরিবহনের পর গত দুই মাস পাইপগুলো পরিবহন বন্ধ ছিল। গত পরশু থেকে ফের এভাবেই ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাইপগুলো পরিবহন শুরু করেছে আর এম মোটরস।

এ সম্পর্কে নগর ট্রাফিক পুলিশের উপ কমিশনার (বন্দর) শাকিরা সোলতানা বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন আশ্বাস দেন ওই কর্মকর্তা।

শেয়ার করুন