আল্লামা শফীর পাশেই চিরনিদ্রায় জুনায়েদ বাবুনগরী

বোরহান উদ্দিন (হাটহাজারী): হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর ও হাটহাজারী দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার শিক্ষাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে (৬৮) আল্লামা আহমদ শফীর পাশেই চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) রাত ১১ টায় নামাজে জানাযা শেষে তাকে সেখানে দাফন করা হয়। বাবুনগরী দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর একটি হাসপাতালে নেয়ার পথে ইন্তেকাল করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিকসসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। এর আগে সকাল ১১ টায় শরীর অসুস্থ বোধ করলে চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি মৃত্যুকালে স্ত্রী, ৫ মেয়ে, ১ পুত্র সন্তান, হাজার হাজার ছাত্রসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন।

তিনি ফটিকছড়ি থানাধীন নাজিরহাট বাবুনগর এলাকার মৃত আল্লামা আবুল হাসানের পুত্র।

এদিকে জানাযার আগে হাটহাজারী মাদ্রাসায় বাবুনগরীর কবর প্রস্তুত করা হলেও বাবুনগরীর ওছিয়তকৃত জায়গা বাবুনগর মাদ্রাসার কবরস্থানে নানার কবরের পাশেও কবর প্রস্তুত করা হয়। বাবুনগরীর মামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বাবুনগরীকে ওছিয়তকৃত জায়গায় কবর দেয়ার জন্য শত চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। বাবুনগরীর লাখো ছাত্র ও ভক্তদের অনুরোধক্রমে অবশেষে আল্লামা শফির পাশেই শায়িত করা হয়।

জানা যায়, হাটহাজারীর সাংসদ ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সর্বোস্তরের লাখো মানুষ অংশ নেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তার ছাত্র ও ভক্তরা এসে ভিড় জমান। বিশৃঙ্খলা এড়াতে হাটহজারী, মহানগর, রাউজান, রাঙ্গামাটি, ফটিকছড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ পুলিশ সতর্কবস্থায় ছিল।

বাবুনগরীর সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্তঃ

বাবুনগরী ১৯৫৩ সালের ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার নাজিরহাট বাবুনগর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবুল হাসান ও মাতা ফাতেমা খাতুন। তিনি হারুন বাবুনগরীর নাতি ও বর্তমান হেফাজতের প্রধান উপদেষ্টা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর ভাগিনা।

জুনায়েদ বাবুনগরী প্রাথমিক অবস্থায় নিজ এলাকার আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগরে ভর্তি হন। সেখানে তিনি মক্তব, হেফজ ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন।

এর পর ভর্তি হন দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসায়। ১৯৭৬ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে পাড়ি জমান পাকিস্তান। ১৯৭৬ সালে করাচিতে অবস্থিত দারুল উলূম আল্লামা বিন্নুরি টাউন মাদ্রাসার জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় তাখাচ্ছুছাত ফিল উলুমুল হাদিস তথা উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগে ভর্তি হন। দুই বছর হাদিস নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করে তিনি আরবি ভাষায় ‘সিরাতুল ইমামিদ দারিমি ওয়াত তারিখ বি শায়খিহি’ (ইমাম দারিমি ও তার শিক্ষকগণের জীবন বৃত্তান্ত) শীর্ষক অভিসন্দর্ভ জমা দেন। এই অভিসন্দর্ভ জমা দেওয়ার পর তিনি জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়া থেকে হাদিসের সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন। ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে বাবুনগরী দেশে ফিরে প্রথমে বাবুনগর মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম বাবুনগর মাদ্রাসায় তিনি উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগ চালু করেন। ২০০৩ সালে তিনি দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসায় যোগ দেন। পরে তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক নিযুক্ত হন। ২০২০ সালের ১৭ জুন মাদ্রাসা কমিটি সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি বাবুনগরীর অনুসারীরা। পরে ১৪ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলন তীব্র হতে থাকলে ১৭ সেপ্টেম্বর মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে মাদ্রাসার দায়িত্ব মজলিশে শুরাকে দিয়ে দেন। ওই দিনই তিনি ইন্তেকাল করেন। পরে বাবুনগরীসহ তিন সদস্যবিশিষ্ট মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়। বাবুনগরী মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস ও শিক্ষা সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান।

২০১০ সালে বাবুনগরীকে মহাসচিব করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সংগঠনটির আমির মৃত্যুবরণের পর ১৫ নভেম্বর সংগঠনের একটি কেন্দ্রীয় সম্মেলনের মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে তিনি আমির নির্বাচিত হন। এ ছাড়া চলতি বছরে ২৫ এপ্রিল হেফাজতের আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক এবং সর্বশেষ ৭ জুন তিনি হেফাজতের আমির নিযুক্ত হন। তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহসভাপতি, চট্টগ্রাম নুরানি তালিমুল কুরআন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং মাসিক মুঈনুল ইসলামের প্রধান সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি নাজিরহাট বড় মাদ্রাসার মুতাওয়াল্লি, মাসিক দাওয়াতুল হকের পৃষ্ঠপোষক, ইনসাফ২৪.কম ও কওমিভিশন.কমের প্রধান উপদেষ্টাসহ কয়েকটি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নেতৃস্থানীয় পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। আরবি, উর্দু ও বাংলায় তার রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৩০টি। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে— সিরাতুল ইমামিদ দারিমি ওয়াত তারিখ বি শায়খিহি, তালিমুল ইসলাম, বাড়াবাড়ি ছাড়াছাড়ির কবলে শবেবরাত, ইসলামে দাড়ির বিধান, তাওহিদ ও শিরক: প্রকার ও প্রকৃতি, মুকাদ্দিমাতুল ইলম: তাফসির, হাদিস, ফিকাহ, ফতোয়া, আকাবিরে দেওবন্দের সিলসিলায়ে সনদ। দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামার আরবি পত্রিকা আল বাসুল ইসলামি, দারুল উলুম দেওবন্দের মাসিক পত্রিকা আদ দায়ী, দারুল উলুম হাটহাজারীর মাসিক আল মুঈনসহ বিভিন্ন সাময়িকীতে তার অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।